নিম্মি #৬
সকালবেলা নাস্তার টেবিলে মেরাজ সাহেব সাধারণত তাঁর কন্যার দেখা পান না। তিনি নাস্তা সেরে অফিসে রওনা হয়ে যাওয়ার পর কন্যার ঘুম ভাঙে। মেরাজ সাহেব নাস্তা করেন একা বসে। শরিফ মিয়া সময়মতো টেবিলে সবকিছু সাজিয়ে রাখেন। লিলির মারা যাওয়ার পর থেকে শরিফ মিয়া থাকেন এই বাসায়। বিশাল বাসার সবকিছু তদারকির দায়িত্ব শরিফ মিয়ার ওপর। দীর্ঘ এই সময়ে দায়িত্ব পালনে কখনও কোন খুঁত রাখেন নি এই মানুষটা। দু'কূলে যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায় শরিফ মিয়ার কেউ নেই। বিয়ে করেছিলেন যুবক বয়সে। ফুটফুটে এক মেয়ে এসেছিলো ঘর আলো করে। শরিফ মিয়া তার হাতের কাছে আঙুল নিয়ে রাখলেই খপ করে মুঠোয় ধরে ফেলতো। দাঁত না ওঠা মাড়ি বের করে ফিক করে হেসে দিতো। সে বহু বছর আগের কথা। সব হারিয়ে গেছে কবেই। ঢিমেতালে বয়ে চলা একলা নদীর মতো এখন শরিফ মিয়ার জীবন, দু'কূলে শুধুই শূন্যতা। মেরাজ সাহেবের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ তিনি। মেরাজ সাহেব না থাকলে হয়তো এখন তিনি অর্ধ-উন্মাদ অবস্থায় গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। গ্রামের ছেলেপেলেরা হয়তো তাকে দেখে মাটির ঢেলা ছুঁড়তো। মেরাজ সাহেবের কারণেই এখন তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। রান্নাবান্না করছেন ইচ্ছেমতো, বাসার কাজের মানুষ আসলে নজরদারি করছেন, অবসর সময়ে বসে টিভি দেখছেন। কখনো ইচ্ছে হলে হাঁটতে বেড়িয়ে পড়েন শহরে, কত উদ্ভট ব্যাপার-স্যাপার চোখে পড়ে তখন। এই পরিবারের একজন সদস্যর মতো হয়ে গেছেন তিনি। নিম্মিকে দেখে আসছেন সেই পিচ্চি অবস্থা থেকে, চোখের সামনে দেখতে দেখতে বড় হয়েছে মেয়েটা। তার নিজের মেয়েটা বেঁচে থাকলে এতোদিনে কতো বড় হতো এমন একটা ভাবনা মাঝে মাঝে নাড়া দেয় তাকে, তিনি পাত্তা দেন না। হারিয়ে যাওয়া জিনিস নিয়ে দুঃখ করার মতো অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আর তিনি যেতে চান না। নিম্মিকে প্রচণ্ড স্নেহ করেন তিনি, যদিও তার প্রকাশ নিতান্তই সামান্য। এতো সকালে নিম্মিকে ডাইনিংরুমে দেখে মেরাজ সাহেবের সাথে স্বভাবতই তিনিও অবাক হলেন, সাথে খুশিও। হাসিমুখে বললেন,
এতো সকাল-সকাল ঘুম ভাঙলো যে মা'জির?
নিম্মিও হেসে উত্তর দিলো,
ঝড়-বাদলের শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছে। নাস্তা দাও তো, চাচা। আজকে কি করেছো?
এই তো, বসো। আমি আনছি।
নিম্মি একটা চেয়ার টেনে বসলো।
গুড মর্নিং, বাবা।
গুড মর্নিং। ঘুম কেমন হলো?
একটু কম হয়েছে, কিন্তু ব্যাপার না। তুমি এতো তাড়াহুড়ো করে খাচ্ছো কেন?
অফিসের সময় হয়ে গেছে রে। রাস্তায় এমনিতেই জ্যাম লেগে থাকে, লেইট…
নিম্মি বাবার কথা শেষ করতে দিলো না।
লাগলে লাগুক, একটু লেইট হলে কিছু হবে না। এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। একদিন না হয় মেয়ের জন্য লেইট করলেই, সকালবেলা তো দেখাই হয় না তোমার সাথে।
মেরাজ সাহেব হাসলেন। হাতের কাঁটাচামচ নামিয়ে রেখে গ্লাসের পানিতে ছোট করে একটা চুমুক দিলেন। নিম্মি বললো,
বাবা, গ্রাম থেকে একবার ঘুরে আসলে কেমন হয়?
মেরাজ সাহেব সরু চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন, মুহূর্তের জন্য। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
হঠাৎ গ্রাম দেখার শখ হলো যে?
এমনিই, হঠাৎ করেই ইচ্ছা হলো। কখনও তো গ্রামে যাওয়া হয় নি, তাই।
হুমম, ঘুরে আসলে তো ভালোই হয়। তোর কলেজের কি খবর? ছুটি-টুটি আছে নাকি?
ছুটি-টুটি ম্যানেজ করা যাবে, সেটা নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি তোমার অফিস ফেলে কবে যেতে পারবে সেটা হলো কথা।
হুম, দেখি। তুই যখন যেতে চেয়েছিস যাওয়া তো অবশ্যই লাগবে। হা হা হা…
নিম্মিও বাবার সাথে হেসে উঠলো। অনেকদিন পর মেরাজ সাহেব মন খুলে হাসছেন। কিচেন থেকে বাবা-মেয়ের হাসি শুনে শরিফ মিয়া খুব সাবধানে লম্বা একটা শ্বাস ফেললেন। নিঃশব্দে প্রার্থনা করলেন, হে সৃষ্টিকর্তা, এদের এই আনন্দে কখনো যেন কমতি না পড়ে…