কন্টেন্টে যাও

ভ্যালেন্টাইন'স ডে থেকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস

চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি, জিনিসটা কী? বিশ্ব ভালোবাসা দিবস? পিছনে যাওয়া যাক, চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি আসলো কিভাবে? একদম সুনির্দিষ্ট কোন কাহিনী নেই। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের একজনের কাহিনী প্রচলিত আছে। সুনির্দিষ্ট কোন কাহিনী নেই বললাম কারণ, প্রচলিত কাহিনীটা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে প্রচলিত। সেরকম কিছু আসলেও কখনো ঘটেছিলো কি না বা ঘটলেও সেটার সাথে প্রচলিত কাহিনীর কতটুকু মিল সেটা জানি না। আমার পক্ষে জানা সম্ভবও না। তার একটা কারণ হচ্ছে আগ্রহবোধ করি না। ইতিহাস নিয়ে ভালো জ্ঞান রাখে এরকম কারো জানা থাকার কথা। স্পষ্টভাবেই ইতিহাস নিয়ে আমার আগ্রহ নেই বললেই চলে। তার থেকে ব্যক্তিগত ভাবনাটা বলা যাক। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর পরপরই কিছু মানুষ তার কাহিনীতে গভীর মর্মাহত হয়ে তার স্বরণে একটা দিনকে নির্দিষ্ট করে পালন করা শুরু করলো, এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আসলে, সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন এমন কিছু করেনও নি যেটার স্বরণে বছরের একটা দিনকে আলাদাভাবে পালন করা যায়। সেখানে আমরা দেখছি, ফেব্রুয়ারি মাসের গোটা একটা দিনের নাম হয়ে গেছে “ভ্যালেন্টাইন’স ডে”। কিন্তু কেন হয়েছে? কিভাবে? চমৎকার একটা মুভি, Eternal Sunshine of the Spotless Mind, থেকে একটা লাইন উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে –

“Today is a holiday invented by greeting card companies to make people feel like crap.”

হুম, এটা শুধু আলাদাভাবে পালিত হওয়া একটা দিনই না, অনেক দেশে এটা রীতিমত ছুটির দিন। আর বলাই বাহুল্য, ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এই ভ্যালেন্টাইন’স ডে-এর উৎপত্তি হয়েছে। এই দিনটাকে কেন্দ্র করে গ্রিটিং কার্ড আর চকলেট কোম্পানিগুলোর আক্ষরিক অর্থেই বড়-সড় একটা ব্যবসা হয়। আর হ্যাঁ, ফুল বাদ গেছে। ফুলেরও রমরমা ব্যবসা এই দিনে। ঠিক কি পরিমাণ কেনা-বেচা হয় এগুলোর সেটা এখানে বলতে পারছি না দেখে আফসোস হচ্ছে। ইন্টারনেট ঘেঁটে সেটা বের করতে হবে, ঘাঁটাঘাঁটি করার মতো উৎসাহ এখন পাচ্ছি না। তবে পরিমাণটা মোটামুটি যে কোন মানুষের আশ্চর্য হয়ে যাওয়ার জন্যে যে যথেষ্ট সেটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। গত বছর কোন একটা সংবাদপত্রের মাধ্যমে পরিমাণটা জেনেছিলাম এবং দুর্বল স্মৃতিশক্তির কল্যাণে অবশ্যম্ভাবীভাবে ভুলে গেছি। এগুলো হলো ভ্যালেন্টাইন’স ডে-কে কেন্দ্র করে শুধু মূল ব্যবসাগুলো, আরো কতো দিক দিয়ে যে কতো রকম ব্যবসা হয় সেটার হিসাব নেই। কর্পোরেট দুনিয়ার এটাই হলো অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্র, আইডিয়া। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন-এর কাহিনীকে কেন্দ্র করে যদি একটা দিনের প্রচলন করে দেয়া যায় তাহলে ব্যবসায় বিরাট একটা লাভজনক ক্ষেত্র তৈরি হবে – করা যাক তাহলে। উপরে উল্লেখ করা লাইনটায় ফিরে যাওয়া যাক। এতো কিছু থাকতে কেন গ্রিটিং কার্ড কোম্পানী? সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে প্রচলিত কাহিনীর শেষ অংশটা জানা যাক। মৃত্যুর আগে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন তার প্রেয়সীকে একটা চিঠি লেখে, চিঠির নিচে স্বাক্ষর করা ছিলো – “Your Valentine”, তোমার ভ্যালেন্টাইন।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। কোথাও কি উল্লেখ আছে World Love Day-এর? শুনতেই তো হাস্যকর লাগছে। কোন বিচিত্র কারণে এদেশের প্রচারমাধ্যমগুলোতে ভ্যালেন্টাইন’স ডে-কে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নামে প্রচার করা হয়। কেন? পুরো ব্যাপারটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা হয় সেটা দেখা যাক আগে। ভ্যালেন্টাইন’স ডে-এর মর্মকথা হলো ভালোবাসা। ভালোবাসা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা প্রতিই হবে, সেটা তো আর না। বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা থাকে, বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থাকে, সর্বোপরি ভালোবাসা সমগ্র মানবজাতির প্রতি। তাই এটা হলো বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, যাকে-পাও-তাকে ভালোবাসা জানানোর দিন হচ্ছে এটা। ভালোই তো, তাই না? আসলে শুধু ভালোই না, শব্দটা হবে চমৎকার। এখন, যা বলা হয় তা না গিলে একটু ভাবা যাক। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এখনো এই ভালোবাসা-বাসির ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়া হয় না। তুমি চুরি করো, নেশা করো, ইভ-টিজ করো, যা-মন-চায়-তাই করো। ব্যাপার না। সমাজ সেটা যতটা সহজভাবে গ্রহণ করবে ভালোবাসার ব্যাপারটা ততো সহজভাবে গ্রহণ করবে না। তুমি কাউকে ভালোবাসো, শুধু এই কারণেই সমাজ, তোমার পরিবার তোমাকে যতো সহজে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখবে, চেষ্টা করে দেখো, কাউকে ঘৃণা করার জন্য সেই দৃষ্টি লাভ করা ততোটাই দুঃরহ। তবে ইদানীংকালে অবশ্য সমাজ আগের তুলনায় অনেকটাই নমনীয়। সমাজ চুলোয় যাক, যেটা বলছিলাম, এতো বড় ব্যবসার সুযোগ কি তাহলে হাতছাড়া হয়ে যাবে? নাহ, এটাকে একটু গ্রহণযোগ্যতা দেয়া গেলেই হলো, সবকিছু মসৃণভাবেই চলবে। এই জায়গায় এসেই ভ্যালেন্টাইন’স ডে হয়ে গেলো বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। সবার জন্য ভালোবাসা। শুধু যে গ্রহণযোগ্যতা পেলো তাই না, ব্যবসার ক্ষেত্রটাও কিছুটা বেড়ে গেলো।

কিছু অতি উৎসাহী ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, যাকে-পাও-তাকে ভ্যালেন্টাইন’স ডে-এর শুভেচ্ছা দেয়া শুরু করে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা! আহা, কি মধুময়! এতোক্ষণ ইতিহাস থেকে দূরে থেকে কথা বলা হয়েছে। ইতিহাসে আমার আগ্রহ কম দেখেই সেটা হয়েছে। এবার অল্প-একটু সেদিকে যাওয়া যাক, যদিও আমার জানা তথ্য সঠিক কি না তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদিবস ছিলো এই চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি। তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিলো, অন্যায়ভাবেই। তাই তার স্বরণে “সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে” পালন করা শুরু করা হয়েছিলো একসময়। সেটা ভ্যালেন্টাইন ও তার প্রেয়সীর ভালোবাসার স্বরণে হয়েছিলো সেটা ভাবার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না আমি। যাই হোক, চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি যখন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আবিষ্কার হলো তখন অবশ্যম্ভাবীভাবেই তাদের ভালোবাসাটাকেই তুলে ধরা হলো। খুব নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য বছরের একটা দিন আবিষ্কৃত হলো। তাই, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, যাকে-পাও-তাকে যে তুমি ভালোবাসো সেটা জানানোর জন্য ভ্যালেন্টাইন’স ডে-কে বেছে না নেয়াই উত্তম। তাদের ভালোবাসা জানানোর জন্য আরো বহু উপলক্ষ্য আছে। কাউকে প্রোপোজ করার জন্যেও ভ্যালেন্টাইন’স ডে খুব একটা সুবিধার বলে মনে হয় না। অবশ্য তুমি স্কুল বা কলেজের স্টুডেন্ট হলে কাউকে প্রোপোজ করার পিছনে কোন যুক্তিই আমি দেখি না। তবুও প্রোপোজ করার জন্য চমৎকারতম দিন হতে পারে জন্মদিন। কাউকে প্রোপোজ করার জন্য ভ্যালেন্টাইন’স ডে থেকে জন্মদিন – অবশ্যই তোমার না, তার – বহুগুণে ভালো পছন্দ। কারণ ব্যাখ্যা করায় যেতে ইচ্ছে করছে না। ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কর্পোরেট সিল মারা কোন দিন নিতান্তই বিরক্তিকর আর বাজে পছন্দ।

একটা অর্থহীন দিন নিয়ে অনেকটা লিখে ফেললাম। উচিত হয় নাই। সবকিছুর একটা উপসংহার থাকে, এটার উপসংহার কি? উপসংহার হলো, সবকিছুর আদৌ উপসংহার থাকে না। কিছু কিছু জিনিসের পুরোটা জুড়েই শুরু। শেষ হওয়ার খুব পূর্বমূহুর্তটাও শুরু, যখন শেষটা আসে সেটাও আসলে শুরুই।

তুমি ভালোবাসার নিঝুম পাড়ে প্রাণের যেন স্পর্শ লাগা
তুমি অনুভবের তেপান্তরে সারা রাত্রি নির্ঘুম জাগা

Love is all about the start which has no ending.

দৃশ্যত অনেককিছুই অদৃশ্য।

ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৪
উত্তরা, ঢাকা।