কন্টেন্টে যাও

সুমি ও ছেলেটা

বিকেলবেলাটা সুমির প্রিয় সময়। দুপুরের রোদটা যখন একটু কমে আসে, বিকেল হতে শুরু করে তখন সে সোজা তাদের বাড়ির ছাদে চলে আসে। ছাদটা গাছপালা দিয়ে ভরা। বিভিন্ন ফুলের গাছ তো আছেই, সেই সাথে বড়বড় ড্রামের ভেতর লাগানো ফল গাছও রয়েছে। বড় গাছগুলোর নিচে ছায়া হয়ে থাকে। সেখানে বসার জন্য বেতের চেয়ার রাখা। ছ’তলার উপর ছাদ। আশেপাশে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায় ছাদে দাঁড়িয়ে। বিকেলবেলা যেদিন বাতাস বইতে থাকে তখন সুমি রেলিংয়ের উপর যেয়ে বসে। ছাদ থেকে চারপাশের দৃশ্য দেখা সুমির পছন্দের একটা কাজ। নিচে রাস্তার উপর প্রায়ই এলাকার ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলে, চিল্লাচিল্লি করে, হাসে। এতো উপর থেকে তাদের চিল্লাচিল্লি শোনা না গেলেও দেখা যায় ভালোভাবেই। চিল্লাচিল্লি, হাসাহাসির শব্দটা সুমি কল্পনা করে নেয়। কখনো কখনো ঝাঁক বেঁধে পায়রার দল উড়ে যায় আকাশ দিয়ে। আশেপাশের কোন বাড়ির ছাদে কেউ শখ করে পায়রা পোষে মনে হয়। আজকে বাতাস উঠেছে ভালো মতোই। বেতের চেয়ার থেকে উঠে রেলিংয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো সুমি। ঠান্ডা বাতাস, আশেপাশে কোথায় বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয়। আকাশের দিকে তাকালো সুমি, মেঘ করেছে। রাতের দিকে বৃষ্টি হলে হতেও পারে। আকাশের দিকে তাকানোর পর থেকে সুমির গান শুনতে ইচ্ছে করছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত, মেঘ বলেছে যাবো যাবো। ছাদে একটা মিউজিক সিস্টেম সেট করতে পারলে ভালো হতো। বিকালে ছাদে এসে মাঝে মাঝেই গান শুনতে ইচ্ছে করে। বেশ কিছুদিন ধরে সে ব্যাপারটা তার বাবাকে বলবে বলে ভাবছে। কিন্তু বলা হচ্ছে না। যখন বাবা সামনে থাকে তখন আর গান শোনার কথা মনে থাকে না। ছাদে আসলে মনে পড়ে শুধু। সুমি জানে বাবাকে বললে ঠিকই ছাদে মিউজিক সিস্টেম লাগানোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সুমি তার বাবার অতি আদরের মেয়ে। কিছু চেয়ে পায়নি এমন এখনো পর্যন্ত হয়নি। সুমি চোখ বন্ধ করে গুনগুন করে গান গাওয়া শুরু করলো। গানের গলা ভালো সুমির। ছোটবেলায় সুমির বাবা বাসায় গানের টিচার রেখে দিয়েছিলেন ওর জন্য। প্রতি শুক্রবার সকালে টিচার আসতো। ছাদেই বসতো ওরা, তবে ছাদটা তখন এখনকার মতো এতো উঁচুতে ছিলো না। তিনতলার উপর ছাদ ছিলো। পুরোটা সময় সুমির মা সাথে থাকতেন। একপাশে চেয়ারে বসে মেয়ের গান শেখা দেখতেন, শুনতেন। গানের টিচার আর সুমি বসতো ছাদের মেঝেতে বিছানো শীতলপাটিতে। মাঝে মাঝে সুমি জিজ্ঞেস করতো,

- আম্মু, তুমি তো গান শেখো না। তুমি শুধু শুধু এতোক্ষণ বসে থাকো কেনো আমাদের সাথে?

তিনি মিষ্টি করে হেসে বলতেন,

- আমার সোনামনিটার গান শুনি বসে বসে।

এখন সুমির মনে হয় শুধু গান শোনা না। বসে থাকার পেছনে অন্য কারণও ছিলো। হাইস্কুলে ওঠার পর গান শেখার উপর সুমির আগ্রহ উঠে গেলো। একদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বাবাকে বললো,

- আব্বু, আমি আর গান শিখবো না।

তিনি ব্যাথিত গলায় বললেন,

- কেনো মা? হঠাৎ করে কি হলো?

- ইচ্ছা করে না, তাই…

মেয়েকে গান শেখানোর ইচ্ছা ছিলো খুব সুমির বাবার। মেয়ের কথায় তাঁর একটু খারাপ লাগলো বটে কিন্তু নিজের খারাপ লাগাটাকে দ্রুত লুকিয়ে ফেললেন। হাসি হাসি মুখে বললেন,

- ঠিক আছে। আমি টিচারকে আসতে মানা করে দেবো।

ছাদের আরো কেউ উঠেছে। খালি পায়ে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে হাঁটছে। তবুও সুমি টের পেয়ে গেলো। গুনগুন করে গান করা থামিয়ে চোখ খুলে তাকালো। চোখে চশমা পড়া উস্কোখুস্কো চুলের একটা ছেলে। সুমির বয়সিই হবে অথবা কিছুটা বড়। ছাদে উঠলে কখনো-সখনো দেখা হয় ছেলেটার সাথে সুমির। কোন ফ্ল্যাটের কোন ভাড়াটের ছেলে হবে হয়তো। সুমি কখনো আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায় না। তাছাড়া ভাড়াটের ছেলের সাথে বাড়িওয়ালার মেয়ের আগ বাড়িয়ে কথা বলাটাও কেন যেনো ঠিক মানায় না। ছেলেটাও সুমিকে না দেখার ভান করে নিজের মতো হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। কোনদিন বা দেখা যায় কোন একটা উপন্যাসের বই নিয়ে ছাদের এক কোণায় বসে একমনে পড়ছে। আজকে ছেলেটা সুমির দিকেই এগিয়ে আসছে হেঁটে। সুমি কিছুটা অবাক হলো, আগে কখনও ছেলেটা ওর সাথে কথা বলেনি বা বলার আগ্রহ দেখায় নি। আজকে কথা বলতে আসছে নাকি! সুমির বেশ কিছুটা দূরে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো ছেলেটা। সুমি চোখের কোণ দিয়ে সেদিকে একবার তাকালো। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে।

- আপনার গানের গলা তো চমৎকার।

সুমি এবার ঘুরে তাকালো ওর দিকে।

- হুম! আমাকে বললেন?

- হা হা… আপনি ছাড়া তো আর আশেপাশে কেউ নেই।

সুমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলো, এমন করে ছেলেটা প্রসংশা করে বসবে ভাবতে পারে নি। লজ্জাভাবটা ঢাকার জন্য গলায় যতটা সম্ভব গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলে উঠলো,

- আপনি আমার গান শুনছিলেন নাকি?

- হুম…

কি বলবে সুমি ভেবে পাচ্ছে না। বিব্রতকর পরিস্থিতি। অপরিচিত একটা মানুষের সাথে বলার মতোও কিছু নেই আবার হুট করে চলে যাওয়াও অভদ্রতা হবে। ছেলেটার নাম জানে না সে এখনো। নাম জিজ্ঞেস করা যায়,

- নাম কি আপনার?

ছেলেটা প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো,

- প্রায়ই বিকালবেলা ছাদে আসেন তাই না?

- প্রায়ই না, প্রতিদিনই আসি। আপনিও তো আসেন দেখি, মাঝে মাঝে… কোন ফ্ল্যাটে থাকেন আপনারা?

এবারও কোন ফ্ল্যাটে থাকে সে কথা এড়িয়ে গেলো সে,

- হুম, আসি মাঝে মাঝেই। আজ আসলাম বৃষ্টিতে ভিজতে।

- বৃষ্টিতে ভিজতে! বৃষ্টি কই?

- আসছে…

- আসছে মানে?!

বলেই সুমি আকাশের দিকে তাকালো। খুব একটা তাড়াতাড়ি বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে না। সুমি বললো,

- এখন তো বৃষ্টি আসবে বলে মনে হয় না। আসলে রাতের দিকে আসতে পারে।

ছেলেটা নিঃশব্দ একটা হাসি দিয়ে বললো,

- আসবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। ভেজার ইচ্ছা না থাকলে আপনি বরং সিড়িঘরে যেয়ে দাঁড়ান।

ছেলেটার হাসি সুন্দর। শুধু সুন্দর না, বেশ সুন্দর। সুমি ইচ্ছে করছে বলতে, আপনার হাসি তো সুন্দর, আরেকবার হাসবেন? কি আশ্চর্য! এটা আবার কি রকম ইচ্ছা। সুমি হেসে ফেললো,

- এতো নিশ্চিতভাবে বলছেন কিভাবে?

- আপনার হাসি তো সুন্দর, আরেকবার হাসবেন?

কি আজব! ঠিক এই কথাটাই সুমির বলতে ইচ্ছে করছিলো একটু আগে। আর ছেলেটা সেইটাই বললো! অপরিচিত একটা ছেলে এরকমভাবে কথা বলবে এটা মেনে নেয়া যায় না। এই ছেলে কি জানে সে কার সাথে কথা বলছে? সে কি জানে যে সুমি এই বাড়ির মালিকের মেয়ে? কড়া গলায় কিছু বলা দরকার একে। না বললে প্রশ্রয় পেয়ে গিয়ে হয়তো আরো একধাপ উপরে উঠে যেচে পড়ে গল্প করতে লেগে যাবে অথবা ফ্লার্টিং চালিয়ে যেতে থাকবে। কিন্তু সুমি তেমন কিছু বলতে পারলো না। সাধারণভাবেই জিজ্ঞেস করলো,

- আপনি চেনেন আমাকে?

ছেলেটা শব্দ না করে আবার হাসলো। সুমি মনে করার চেষ্টা করলো, ছেলেদের এমন সুন্দর হাসি সে আর কোথাও দেখেছে কিনা। হঠাৎ কোথা থেকে যেন একফোঁটা পানি এসে সুমির মুখের উপর পড়লো। বৃষ্টি শুরু হলো নাকি?! সুমি আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালো। মেঘ ফেটে গিয়ে সহস্র বৃষ্টিফোঁটা ঝরে পড়তে শুরু করেছে।

( এপ্রিল ১০, ২০১৩ )